জন্ডিস কী – জন্ডিস রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে জেনে নিন
জন্ডিস বলতে সাধারণত লিভারের প্রদাহ জনিত রোগকে বোঝায়। হেপাটাইটিস ই, এ এবং বি ভাইরাসের কারণে জন্ডিস হয়ে থাকে। প্রাথমিক অবস্থায় জন্ডিস নিয়ে অবহেলা করলে পরবর্তীতে এটি মারাত্মক আকার ধারণ করে। তাই আমাদের সকলের উচিত জন্ডিস প্রতিকার সম্পর্কে সঠিক ধারণা থাকা।
আজকের এই আর্টিকেলটিতে আমরা জানবো জন্ডিস হলে আপনি কি খেতে পারবেন এবং পারবেন না। শুধু তাই নয় জন্ডিস হলে রোগীর ডায়েট কী রকম হওয়া উচিত সেই সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ধারণা পেয়ে যাবেন। তাই চলুন, আর দেরি না করে জেনে নেওয়া যাক।

জন্ডিস এমন একটি রোগ যা প্রায় সব বয়সের মানুষদেরই হয়ে থাকে। জন্ডিস অনেকটা কলেরা বা ডায়রিয়ার মতো। যা আগে থেকে বিদ্যমান স্বাস্থ্য সমস্যার কারণে বিকাশ লাভ করে। যদি সঠিক সময়ে জন্ডিস প্রতিকারের পদক্ষেপ নেওয়া যায় তাহলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এটি সেরে যায়। তাই আমাদের সবার জেনে রাখা প্রয়োজন কিভাবে আমরা জন্ডিস থেকে বাঁচতে পারব।

জন্ডিস কি?

জন্ডিস কোন রোগ নয় রোগের লক্ষণ মাত্র। জন্ডিস শব্দটি এসেছে ফরাসি শব্দ যোনিস থেকে যার অর্থ হলো হলদেটে। জন্ডিস হলে ত্বক ও চোখে সাদা অংশ এবং অন্যান্য মিউকাস জেলি হলুদ হয়ে যায়। মানবদেহের রক্তে লোহিত কণিকা গুলি স্বাভাবিক নিয়মে একটা সময় ভেঙে যায় যা পরবর্তী সময়ে লিভারে প্রক্রিয়াজাত হয়ে পিত্তরসের সঙ্গে মিশে পরিপাকতন্ত্রের প্রবেশ করে। এই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া কোন কারণে ব্যাহত হলে জন্ডিস দেখা দেয়।

জন্ডিস কেন হয়?

ভারত বাংলাদেশ সহ প্রায় সারা বিশ্বে জন্ডিসের প্রধান কারণ হলো হেপাটাইটিস ভাইরাস। আর উন্নত দেশগুলোতে অতিরিক্ত মদ্যপান জন্ডিসের একটি কারণ। আমাদের দেশের জন্ডিসের প্রধান কারণ হলো হেপাটাইটিস ই এ এবং বি ভাইরাস। এর মধ্যে হেপাটাইটিস ই এবং এ হলো পানি ও খাদ্য বাহিত আর হেপাটাইটিস বি মূলত ছড়ায় রক্তের মাধ্যমে। তবে যেকোনো বয়সের মানুষই হেপাটাইটিস ই এবং বি ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে।
এছাড়া থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের জন্ডিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। লিভার কোষ, অগ্নাশয়, পিত্তনালী এবং যকৃতের ক্যান্সারের মত সমস্যাগুলিও জন্ডিসের কারণ হিসেবে পরিচিত। তবে লিভারের রোগই হলো জন্ডিসের প্রধান কারণ।

জন্ডিস রোগের লক্ষণ

  • চোখের সাদা অংশ এবং ইউরিন এর রং হলুদ হয়ে যায়
  • শারীরিক দুর্বলতা ও খিদে কমে যায়
  • জ্বর জ্বর অনুভূতি বা কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসা
  • বমি বমি ভাব
  • ওজন কমে যায়
  • শরীরে বিভিন্ন জায়গায় চুলকানি
  • মাথা ব্যথা ও জ্বর

জন্ডিস প্রতিকারে কার্যকরী যে ৭টি খাবার

একটি কথা মনে রাখবেন জন্ডিস কিন্তু শুধু ঔষধের সারানো সম্ভব নয়। জন্ডিসের আক্রান্ত রোগীদের খাওয়া দাওয়ার দিকে নজর দেওয়া খুব দরকার। ওষুধের পাশাপাশি এমন কিছু খাবার আছে যা জন্ডিস কমাতে সাহায্য করে। যেমন-
১.টমেটোঃ টমেটোর মধ্যে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আছে এবং এটি ভিটামিন সি তে পরিপূর্ণ। টমেটো জুস যদি অল্প পরিমাণে নুন দিয়ে খালি পেটে দশ থেকে বারো দিন খাওয়া যায় তাহলে ভালো ফল পাওয়া যায়। এছাড়া কাঁচা টমেটো বা সালাদ হিসেবে খেতে পারেন।

২.আমলকিঃ এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি রয়েছে। জন্ডিস কমানোর জন্য আমলকি খুব কার্যকরী ভূমিকা পালন করে থাকে। আমলকি যকৃতের কোষকে সক্রিয় করে তুলতে সাহায্য করে। তবে আমলকি কাঁচা খাওয়ার চেষ্টা করবেন। শুকনো আমলকির চেয়ে কাঁচা আমলকি বেশি কার্যকরী। কারণ এতে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার রয়েছে, আর এই ফাইবার পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে।

৩.আখের রসঃ জন্ডিসের বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষেত্রে আখের রস আপনার অন্যতম হাতিয়ার হতে পারে। প্রতিদিন নিয়ম করে এক গ্লাস আখের রস খেতে পারলে যকৃতের কার্যক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব। তাই আপনার লিভার সুস্থ রাখতে আপনি প্রতিদিন আখের রস খেতে পারেন। তবে রাস্তার ধারে বিক্রি হওয়া আখের রস একদম খাবেন না।

৪.লেবুর রসঃ লেবুতে ভিটামিন সি প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। লেবু পিত্তনালী পরিষ্কার করে। খালি পেটে যদি পাতি লেবুর রস খান তাহলে খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন। এছাড়া হালকা গরম পানিতে লেবু এবং সামান্য পরিমাণে লবণ মিশিয়ে খেতে পারেন।

৫.গাজরঃ এতে প্রচুর পরিমাণে বিটা করোটিন আছে। এছাড়া ভিটামিন এ এবং সি রয়েছে। বিটা ক্যারোটিন খারাপ কোলেস্টরেলের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। এছাড়াও গাজর কিন্তু যকৃতের অবাধ কাজে সাহায্য করে থাকে। তাই অল্প পরিমাণে গাজর আপনার ডায়েট এ অবশ্যই রাখুন। এতে সুফল পাবেন।

৬.বেদেনাঃ এতে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে। এমনকি এতে সোডিয়াম পাওয়া যায়। যা জন্ডিস কমাতে সাহায্য করে। তাই নিয়মিত অল্প পরিমাণে আপনার ডায়েটে যোগ করতেই পারেন বেদেনা। এছাড়া বেদেনের রস জুস করে খেতে পারেন।

৭.কাঠবাদামঃ প্রতিদিন যদি দুই থেকে চারটি করে ভেজানো কাঠবাদাম খাওয়া যায় তাহলে যকৃতের স্বাভাবিক কাজ অক্ষুন্ন রাখা সহজ হয়। কাঠবাদাম শরীর থেকে দূষিত পদার্থ বের করে দেয় এবং শরীরে শক্তি সঞ্চয় করতে সাহায্য করে।

আরো পড়ুন: রোগ নিরাময়ে আদার উপকারিতা।

আপনার প্রতিদিনের ডায়েটে কোন খাবারগুলো রাখতে পারবেন

জন্ডিস হলে রোগীর খাবার কি হবে তা নিয়ে অনেকের ভেতর অনেক বিভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। জন্ডিস হলে এমন খাবার খাওয়া উচিত যেন যকৃত ও পিত্তথলি ওপর কোনো চাপ না পরে। এর জন্য আমাদের খাদ্য তালিকায় কিছু শাকসবজি রাখতে পারি যেমন- মিষ্টি আলু, ব্রকলি, বাঁধাকপি, ফুলকপি, গাজর, লাল শাক, পুঁইশাক, পালং শাক ইত্যাদি জন্ডিস রোগীর জন্য খুবই ভালো অনেকে মনে করেন।

জন্ডিসের আক্রান্ত রোগীরা প্রোটিন জাতীয় খাবার খেতে পারবে না এটা আসলে ভুল ধারণা। খাদ্য তালিকায় প্রতিদিন মাছ ডাল থাকতে হবে। তা না হলে কিন্তু রোগী দুর্বল হয়ে যাবে। তবে তেল ও মসলা কম পরিমাণে খেতে হবে, বেশি বেশি এন্টিঅক্সিডেন্ট যুক্ত খাবার খেতে হবে। যেমন- লেবু, লেবুর রস, টমেটো। জন্ডিসের আক্রান্ত রোগীর জন্য খুবই ভালো এগুলো। শরীরের পানির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
এছাড়া প্রতিদিন সামান্য পরিমাণে বাদাম খেতে পারেন, সামান্য আদা কুচি, রসুন কুচি, আদার রস, আদা চা খেতে পারেন দিনে দুই থেকে একবার করে। এগুলো যকৃতের জন্য খুবই উপকারী। ফলের মধ্যে পেঁপে, আনারস, তরমুজ, আম, কমলা, জলপাই, ডালিম, বেদেনা এবং আঙ্গুলের মত ফল প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় রাখতে পারেন। ভিটামিন এ এবং ই জাতীয় খাবার বেশি খেতে হবে।

জন্ডিসের সময় কোন কোন খাবার খাওয়া উচিত নয়

  • কাঁচা লবণ
  • দুধ বা পনির
  • অতিরিক্ত মিষ্টি জাতীয় খাবার
  • অতিরিক্ত তেল জাতীয় খাবার
  • অতিরিক্তমসলাযুক্ত খাবার
  • অ্যালকোহল
  • ফ্যাট যুক্ত খাবার

জন্ডিস হলে যেসব নিয়ম মেনে চলতে হবে

জন্ডিস এমন একটি রোগ যার সঠিক সময় প্রতিকার না হলে পরবর্তীতে ভয়ানক আঁকার ধারণ করে। জন্ডিসে আক্রান্ত হলে রোগীকে পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে। এছাড়া তরল জাতীয় খাবার এবং সহজে হজম হয় এই ধরনের খাবার খেতে হবে। এ সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জন্ডিস এর সময় সঠিক নিয়ম মেনে চললে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে জন্ডিস সেরে যায়।

শেষ কথা

জন্ডিস নিয়ে বিভ্রান্তের কোনো কারণ নেই। জন্ডিস হলে আমাদের সচেতনতার মাধ্যমে এই রোগটি সারিয়ে তুলতে পারি। জন্ডিস যেহেতু মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায় তাই আমাদের অবশ্যই জন্ডিস সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। জন্ডিস হলে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে এবং সঠিক নিয়ম অনুযায়ী জীবন যাপন করতে হবে। আজকের এই আর্টিকেলটি যদি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে শেয়ার করবেন।। ধন্যবাদ।